
ব্যাংকের জলপাই রঙের বিল্ডিং : কারণ ও ধারনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ইতিহাস লেখা হয়েছিল বটে, কিন্তু তা দেখার সুযোগ হয়নি। তবে, তাতে গতানুগতিকতার বাইরে কোন তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। সে শুভঙ্করের ফাঁক পূরণের জন্য আমরা সবাই স্মৃতিনির্ভর কিছু না কিছু কন্ট্রিবিউট করতে পারি।
শুরুতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের শুরুর দিকের কথা এবং জলপাই রংয়ের বিল্ডিংয়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যেতে পারে।
ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক হিসাবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। দেশ বিভাগের পরও কিছুদিন যাবত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া পাকিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাংক হিসেবে কাজ করেছিল।
১৯৪৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট দু'দেশের মধ্যে ব্যাংকের রিজার্ভ--স্বর্ণ ও ফরেন এক্সচেঞ্জ-- বন্টন করে। পাকিস্তানের অংশে পড়ে ৩০%। সম্পদের মূল্য ৭৫ কোটি রুপি। সম্ভবত, রিজার্ভ ব্যাংক থেকে পাকিস্তানে সে অংক ট্রান্সফার করা হয়নি। বহু বছর যাবৎ স্টেট ব্যাঙ্কের হিসাবের বইতে "রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে প্রাপ্তব্য" বলে asset হিসাবে এখনো দেখানো হয়ে থাকে। কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই অবস্থা।
সে সময় সেন্ট্রাল ব্যাংকের রিজার্ভ হিসেবে রাখা হতো মূলত স্বর্ণ, পাউন্ড স্টার্লিং এবং মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের নিয়ম অনুযায়ী, স্বর্ণ এবং ফরেন এক্সচেঞ্জের অনুপাতে কাগজের মুদ্রা ইস্যু করা যেত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়। স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের রিজার্ভ তারা পুরোপুরিভাবে হজম করে ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে না ছিল স্বর্ণের মওজুদ, না ছিল ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ। শুন্য রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনিশ্চিত পথযাত্রা। খোদার কি শাণ! এখন আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ২১ বিলিয়ন।
১৯৪৮ সালের মে মাসে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্রুত স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত করা্র জন্য পদক্ষেপ নেন। ওই বছরেই জুন মাসে স্টেট ব্যাংকের জন্ম হয়। ১লা জুলাই,১৯৪৮ স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পথযাত্রা শুরু হয়।
স্টেট ব্যাংকের নতুন বিল্ডিং তৈরি হয় করাচির ম্যাকলিওড রোডে। বর্তমান নাম আই আই চুন্দ্রিগড় রোড। ১১ তলা বিল্ডিংটি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ এবং প্রথম আধুনিক স্থাপনা। নিখিল পাকিস্তানের প্রথম চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটরও সে ভবনে স্থাপন করা হয়।
দৃষ্টিনন্দন সে ভবনটির উদ্বোধন হয় ১৯৬১ সালে। সারা দুনিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রতিপালিত হয়। তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানের দর্শনীয় স্থানগুলো সফর করার জন্য একটা স্পেশাল ট্রেনও চালু করা হয়।
ঢাকার সদরঘাট এলাকায় ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার শাখা অফিস রূপান্তর করে স্বল্প পরিসরের দুটো পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের ঢাকা শাখার কার্যক্রম শুরু হয়।
পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তানে স্টেট ব্যাংকের সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য ডেপুটি গভর্নর অফিস স্থাপন করা হয় মতিঝিলে একটা ভাড়া করা অফিসে। নামেই যা ডেপুটি গভর্নর অফিস। সব আদেশ-নির্দেশ করাচি থেকে পাঠানো হতো।
কালক্রমে চট্টগ্রাম, খুলনা এবং বগুড়ায় শহরে শাখা স্থাপন করা হয়। প্রবাসীদের অর্থ প্রদানের বিষয়টি দেখাশোনার জন্য সিলেটে একটা ছোট্ট ইউনিট করা হয়েছিল। ইউনিটের প্রধান ছিলেন একজন অ্যাসিস্টেন্ট কন্ট্রোলার অব ফরেন এক্সচেঞ্জ।
মতিঝিলের শাপলা চত্বরের পাশে জলপাই রংয়ের ভবনটি ষাটের দশকের মাঝা-মাঝি সময়ে স্টেট ব্যাংকের ঢাকা ব্রাঞ্চ হিসাবে উদ্বোধন করা হয়। সে সময় বিল্ডিংটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম আধুনিক ইমারত। স্থপতি প্রতিষ্ঠান থারিয়ানি এন্ড কোম্পানি।
কোম্পানির প্রধান আব্দুলহসেন এম থারিয়ানি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, মুম্বাইয় থেকে করাচীতে চলে আসেন। সেখানে একটা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর পঞ্চাশ দশকে নিজস্ব নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
তাঁর কোম্পানি পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি আধুনিক ইমারত তৈরি করে। ঢাকার আদমজী কোর্ট, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাজউক ভবন তাঁর নকশায় তৈরি হয়। থারিয়ানির নকশা অনুযায়ী ব্যাংকের ভবনটি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রয়াত জহুরুল ইসলাম সাহেবের বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিকে।
বিল্ডিংটি প্রথম দর্শনেই ভাল লাগে। সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। থারিয়ানি সাহেব শুধু স্থপতিবিদই ছিলেন না, গুজরাটি ভাষায় কবিতাও লিখতেন। স্কুলের পাঠ্য পুস্তকেও তাঁর কবিতা স্থান করে নিয়েছিল। সন্দেহ নেই, এ স্থাপনায় তাঁর কাব্যরসের পরশ বুলিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন নাই। আমরা প্রতিদিন দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই হয়তো বিল্ডিংটির সৌন্দর্য তাকিয়ে দেখার তাগিদ অনুভব করি না।
এ বিল্ডিংয়ে স্থান সঙ্কূলান না হওয়ায় আশি-নব্বই দশকে পুরনো ভবনের পাশে ত্রিশ তলা ভবনটি তৈরি হয়। এ বিল্ডিংয়ে সৃজনশীলতা বা কাব্যরসের ছোঁয়া ত নাই, বরং কল্পনায় ভেসে উঠে রূপকথার দুষ্টু দৈত্যের চেহারা যে থারিয়ানির কল্পনার রাজকুমারীকে গ্রাস করতে উদ্যত। বিস্ট এন্ড বিউটির সহাবস্থান।
শোনা যায়, যে জায়গায় স্টেট ব্যাংকের সাত তলা বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানে এক কালে শ্মশানঘাট ছিল। অনেকে নাকি রাত্রে কোন কোন তলায় অশরীরী আত্মার আনাগোনা দেখেছে। তাঁরা নিঝুম রাতে টাইপ রাইটার চালানোর খট খট শব্দও শুনতে পেত।
টাইপ রাইটারের দিন শেষ হয়েছে। এখন কম্পিউটারে নিঃশব্দে কাজ চলে। এ কারণে হয় ত টাইপের শব্দ শোনা যায় না। অথবা এমনও হতে পারে যে সেকালের ছায়া জগতের অশরীরী বাসিন্দারা কম্পিউটার চালানো শিখে উঠতে পারে নাই।
তবে, বিল্ডিংটির সাথে অভিশাপ জড়িয়ে আছে। অশরীরী আত্মার প্ররোচনায় কিনা জানি না, বেশ কয়েকজন ব্যাংকের উপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। যত দূর মনে পড়ে সত্তর দশকের শেষে লিয়াকত নামের একজন তরুণ প্রতিভাবান কর্মকর্তা এনেক্স বিল্ডিংয়ের উপর থেকে লাফিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। ৩০ তলা বিল্ডিংয়ের উপর থেকেও বহিরাগত একজন লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন। সে কারণে ব্যাংকের ছাদে ওঠার ব্যাপারে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
শুরুতে প্লান ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ভবনটি হবে সাতাশ তলা। বিল্ডিংটি নির্মাণে কন্ট্রাক্টর ও ব্যাংকের টানাপড়েন চলছিল বারবার। গুজব বা সত্যি কিনা জানিনা, নির্মাণ কাজের এক পর্যায়ে গণনা করে দেখা গেল যে সাতাশ তলার লিমিট ছাড়িয়ে ত্রিশ তলায় পৌঁছে গেছে। কন্ট্রাক্টর দাবী করল, আমি বর্গ ফুট হিসাবে কাজ করেছি। ব্যাংক বলল, আমরা ত তোমাকে সাতাশ তলা বানাতে ফরমায়েশ করেছিলাম। সে ঝগড়া কি করে মিটল এত দিন পরে তা মনে নাই। তবে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকল বহু দিন। এসব আজব কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে বিল্ডিংটি আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
আরবিট্রেটর যোগাড় করে ঝগড়া বিবাদ মিটাতে অনেকগুলো বছর নষ্ট হল। একই ঘটনা ঘটে ব্যাংকের অন্যান্য শাখা অফিসের বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে। অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকে বছরের পর বছর। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আরবিট্রেটর সাহেব ঠিকাদারের অনুকূলে রায় দিয়ে থাকেন। বিলম্বের কারণে মূল্য বৃদ্ধির খেসারত কন্ট্রাক্টর তাঁর চাহিদা মোতাবেক এক কাড়ি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পায়। অশরীরী আত্মার ভেলকিবাজি কিনা কে জানে @সৈয়দ আশরাফ আলী