
৫ বছর আগে বিল গেটস কি আমাদের করোনার কথাই বলেছিলেন ?
"পারমাণবিক শিকল আঁটার জন্য আমরা যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছি, কোন মহামারী সামাল দেয়ার জন্য তার তুলনায় সামান্যই বিনিয়োগ করেছি। পরবর্তী মহামারীর জন্য আমরা প্রস্তুত নই"
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর বিল গেটসের একটা বক্তৃতার ভিডিও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আরও পাঁচ বছর আগে টেড টকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিল গেটস বলছিলেন- “মিসাইল নয়, মাইক্রোবস।” তিনি বলছিলেন, এমন কোনো ভাইরাস একটি মহামারী ঘটাতে চলেছে, যার আক্রমণে মানুষ প্রথমে বুঝবেই না সে অসুস্থ। বিল গেটসের কল্পিত সেই ভাইরাসই কি কোভিড-১৯ ? কোভিড-১৯ কি আসলেই প্রাকৃতিক ভাইরাস? নাকি কোনো জৈব অস্ত্র? বিল গেটস দ্বিতীয়টির সন্দেহকেও নস্যাৎ করেননি। প্রখর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন এই মানুষটির সেই বক্তব্য পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে বাংলায় অনুবাদ করে দেয়া হলো। পাঁচ বছর আগে বিল গেটস যে ধরণের প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেছিলেন, তা কি দুনিয়া নিতে পেরেছে?? আসুন পড়ি টেড-এ কি বলেছিলেন বিলগেটস……
ছেলেবেলায় আমরা সবচে’ বেশি আতঙ্কিত থাকতাম পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে। আমাদের ভুগর্ভস্থ ঘরে তাই খাদ্য আর পানীয়ে ভর্তি একটা পিপে রাখতাম আমরা। কথা ছিলো, পারমাণবিক আক্রমণ শুরু হলে আমরা সেই ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকবো, তখন সেই পিপেই হবে আমাদের খাবারের সংস্থান।
এখন কিন্তু বৈশ্বিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি ওরকম ধরণের নয়। এটা হলো এরকম- (ছবি)। আগামী কয়েক দশকে কোন কিছু যদি ১০ মিলিয়নের ওপর মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, তাহলে কারনটি মোটেও যুদ্ধ হবে না, মানুষ মারা পড়বে কোনো ভয়ংকর ছোঁয়াচে ভাইরাসের কম্মে। মিসাইল এর আঘাতে নয়, মারা পড়বে ক্ষুদ্রজীবানুতে। এর আংশিক কারণ এই যে, পারমাণবিক শিকল আঁটার জন্য আমরা যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছি, কোন মহামারী সামাল দেয়ার জন্য তার তুলনায় সামান্যই বিনিয়োগ করেছি। পরবর্তী মহামারীর জন্য আমরা প্রস্তুত নই।
ইবোলার দিকে তাকানো যাক। আমি নিশ্চিত, আপনারা সবাই পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে পড়েছেন, অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। পোলিও দূরীকরণের হদিস রাখার জন্য আমাদের ব্যবহৃত ‘কেইস এ্যানালাইসিস টুলস’ দিয়ে আমি খুব সতর্কভাবে এটা পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। কী ঘটেছিল সেদিকে যদি দৃষ্টিপাত করেন, দেখবেন, সমস্যাটা এরকম ছিল না যে কোনো সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করেনি। সমস্যাটা ছিল, আমাদের আদৌ কোনো সিস্টেম ছিল না। সত্যি বলতে, মূল কিছু ব্যাপার অনুপস্থিত ছিল।
যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত মহামারী বিশেষজ্ঞ দল ছিল না আমাদের, যারা হদিস রাখতে পারত রোগটা কিরকম, কত দূর ছড়িয়েছে। আমাদের ভরসা করতে হয়েছে পত্রিকাগুলোর ওপর। যতদিনে অনলাইনে ছড়িয়েছে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিপোর্টগুলোও ছিল ভুলে ভরা। আমাদের কোনো মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত ছিল না। লোকজনকে প্রস্তুত করার কোনো উপায় ছিল না আমাদের। Médecins Sans Frontières স্বেচ্ছাসেবক দল সাজিয়ে দারুণ একটা কাজ করেছিলেন। কিন্তু তারপরও, আক্রান্ত দেশগুলোতে হাজার হাজার কর্মী নিয়োগ করার ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক ধীর ছিলাম। একটা বড় মহামারীতে শত হাজার কর্মীর প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসার অগ্রগতিতেও তেমন কেউ ছিল না। রোগ নির্ণয়ে ছিল না। কী ধরনের যন্ত্রপাতি লাগবে, ছিল না সেটা বের করার মত লোক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা বেঁচে যাওয়াদের রক্ত নিতে পারতাম, প্রসেস করতে পারতাম, সেগুলো সংরক্ষণ করার জন্য তাদেরকেই ফেরত দিতে পারতাম। কিন্তু সেটা কখনোই চেষ্টা করা হয় নাই।
অতএব বলা যায়, অনেক কিছুই ছিল না। এবং এগুলোকে সত্যিই বৈশ্বিক ব্যর্থতা বলা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ফান্ড দেয়া হয়েছিল পর্যবেক্ষণের জন্য, কিন্তু আমি যা বলছি তার কোনো কিছুই করার জন্য তাদের ফান্ড দেয়া হয় নাই। মুভিগুলোতে অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সেগুলোতে ডাকসাঁইটে মহামারীবিদদের দেখা যায়, তারা ছোটাছুটি করে, সময়টা বাঁচায়, কিন্তু সেটা কেবলই বিশুদ্ধ হলিউড!
এসব প্রস্তুতিতে ব্যর্থতা কেবল পরবর্তী মহামারী ইবোলার চেয়েও আরও বিধ্বংসী হওয়ারই অনুমোদন। বছরজুড়ে ইবোলার উন্নয়নের দিকে তাকানো যাক। প্রায় ১০,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তার মধ্যে ৩০০০ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে। তিনটা কারণে এই ভাইরাস খুব একটা ছড়াতে পারে নাই। প্রথমত, স্বাস্থ্যকর্মীরা বাহবা কুড়ানোর মত কাজ করেছিল প্রচুর। তারা আক্রান্তদের খুঁজে বের করতে পেরেছিল। ফলে আরও বেশি আক্রান্ত হওয়াকে প্রতিরোধ করা গেছে। দ্বিতীয়ত, ভাইরাসটির প্রকৃতি। ইবোলা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়নি। তৃতীয়ত, এটা অনেক শহুরে এলাকায় ছড়ায়নি। এটা শুধুমাত্র সৌভাগ্য। যদি অনেক শহুরে এলাকায় ইবোলা ছড়িয়ে পড়ত, মৃত্যুর মিছিল আরও অনেক বড় হত।
সুতরাং, পরেরটার ক্ষেত্রে আমরা সেরকম সৌভাগ্যবান হব না হয়ত। আপনি এমন কোনো ভাইরাসের সম্মুখীন হতে পারেন, যাতে আক্রান্ত হলেও লোকজন ভালো বোধ করবে। তারা প্লেনে যাতায়াত করবে, বাজারে যাবে। ভাইরাসটির উৎস ইবোলার মতো প্রাকৃতিক হতে পারে, হতে পারে কোনো জৈব সন্ত্রাসও। অতএব, আক্ষরিক অর্থেই অবস্থা হাজার গুণ দুর্দশাপূর্ণ হওয়ার মতো ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে।
বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে এমন ভাইরাসের মডেলের দিকে তাকানো যাক। স্প্যানিশ ফ্লু ১৯১৮ সালে ফিরে এসেছিল। সারা বিশ্বে দ্রুত, খুবই দ্রুত এটা ছড়িয়ে পড়েছিল। ৩০ মিলিয়নের ওপর মানুষ মারা গিয়েছিল। কাজেই, এটা একটা ভয়ানক সমস্যা। আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত।
কিন্তু আমরা আসলে খুব ভালো একটা ‘রেসপন্স সিস্টেম’ বানিয়ে ফেলতে পারি। আমাদের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উপকারীতা আছে। আমাদের কাছে মুঠোফোন আছে, যেগুলো দিয়ে আমরা জনগণের কাছ থেকে তথ্য আদায় করতে পারি। আমাদের স্যাটেলাইট ম্যাপ আছে, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা কে কোথায় আছে, কোনদিকে যাচ্ছে দেখতে পারি। আমাদের জীববিজ্ঞানে অগ্রগতি হয়েছে, সেটার উচিত সময়ের পালাবদলে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হওয়া, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু পর্যবেক্ষণ করা এবং এমন ওষুধ আর টিকা তৈরিতে সক্ষম হওয়া, যা কিনা ঐ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর জন্য ঠিকঠাক কাজ করে। তাই আমাদের দরকার যন্ত্রপাতি। আর ঐসব যন্ত্রপাতি অবশ্যই সামগ্রিক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে থাকতে হবে। আমাদের দরকার প্রস্তুতি।
প্রস্তুতির সর্বোত্তম শিক্ষা নিতে হবে যুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে। যোদ্ধাদের জন্য আমাদের সমস্ত সময় বরাদ্দ থাকে কেবল ঝাঁপিয়ে পড়ার লক্ষ্যে। ন্যাটোর মোবাইল ইউনিট আছে, যারা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। ন্যাটোর অনেক রকমের রণকৌশল যাচাই করা যেতে পারে। লোকজন প্রশিক্ষিত আছে তো? তারা জ্বালানী এবং রীতিনীতিগুলো এবং একই রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিগুলো বোঝে তো? মহামারীর সঙ্গে লড়ার ক্ষেত্রে এই ধরণের বিষয় আমাদের দরকার।
তাহলে মূল বিষয়গুলো কী? প্রথমত, দরিদ্র দেশগুলোতে শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রয়োজন। মায়েরা নিরাপদে যেন সন্তানের জন্ম দিতে পারে, শিশুরা যেন তাদের প্রয়োজনীয় টিকাগুলো পায়। কিন্তু আমরা খুব দ্রুত মহামারীও দেখতে চলেছি। আমাদের দরকার একটা মেডিক্যাল রিজার্ভ কর্প- অনেক অনেক প্রশিক্ষিত মানুষ, যারা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করবে। আর এই মেডিক্যাল কর্প্সকে জুড়ে দিতে হবে মিলিটারির সঙ্গে। মিলিটারিদের দ্রুত ছোটাছুটি করার, নিয়ম মানার এবং এলাকা সুরক্ষিত রাখার দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার জন্য নয়, আমাদের আদিখ্যেতা দরকার জীবাণু নিয়ে খেলার, যাতে আমরা বুঝতে পারি কোথায় ফাঁক-ফোঁকরগুলো আছে। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ জার্ম-গেইম শেষ হয়েছে ২০০১ সালে, যেটা খুব একটা ভালো হয়নি। জীবাণুর স্কোর যদি ১ হয়, মানুষের স্কোর তাতে শুণ্য। টিকা এবং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দরকার প্রচুর অগ্রগামী গবেষণা এবং উন্নয়ণ।
আমি ঠিক জানি না, এর জন্য ঠিক কত বাজেট লাগবে। কিন্তু আমি একদম নিশ্চিত, সার্বিক ক্ষতির তুলনায় সেটা সামান্যই। বিশ্ব ব্যাংক একটা হিসাব দিয়েছে যে, আমরা যদি কোনো বৈশ্বিক মহামারীর মুখোমুখি হই, বিশ্বের সম্পদ ট্রিলিয়ন ডলার নেমে যাবে, মিলিয়ন মিলিয়ন মৃত্যু তো ঘটবেই। এই বিনিয়োগগুলো তাৎপর্যপূর্ন হতে পারে মহামারীর জন্য প্রস্তুত হওয়ার ক্ষেত্রে। প্রাথমিক স্বাস্থসেবা, R&D এগুলো বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সাম্যতা নিশ্চিত করবে এবং পৃথিবীকে করবে আরও নিরাপদ।
তাই আমি মনে করি, এটাকে অবশ্যই একটা প্রায়োরিটি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। আমাদেরকে ভুগর্ভস্থ ঘরে লুকোতে হবে না। কিন্তু আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, কেননা- সময় আমাদের পক্ষে নেই। যদি আমরা এখনই শুরু করি, আমরা পারব পরবর্তী মহামারীর জন্য প্রস্তুত হতে। ইবোলা যদি কোনো ইতিবাচক শিক্ষা দিয়েই থাকে, তবে সেটা হলো আমাদের জেগে ওঠার সংকেত।