মন-মস্তিষ্কের রসায়ন

মন-মস্তিষ্কের রসায়ন


    নাজমুল হুদা

আমাদের পায়ের পাতায় কাটা ফুটলে আমরা যেমন ব্যথা অনুভব করি আবার মাথার চুল ধরে কেউ টানলেও বুঝতে পারি। শুধু যে বুঝে ক্ষান্ত হয় তা নয়। সাথে সাথেই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়ে মস্তিস্ক থেকে যথাস্থানে তাৎক্ষণিক নির্দেশনা (সিগনেল) পাঠায়। যেমন আমাদের এক হাতে মশা কামড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিস্কে সেনসরি সিগনেল পৌছে যায় যকে ইমপালস বলে। আবার আরেক হাত দিয়ে মশাকে আঘাত করার জন্য মস্তিস্ক থেকে যে সিগনেল যায় তাকে মটর রেসপন্স বলে। সদ্যপ্রয়াত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকস এর ’মটর নিউরন’ নিস্ক্রিয় ছিল বিধায় তিনি কম্পিউটারের সহায়তায় সব কাজ করতেন। তিনি বলতেন ‘মানুষের মস্তিস্ক হল কম্পিউটার, বোধ হল প্রোগ্রাম’।

আমরা মস্তিস্কে যে ধরনের প্রোগ্রাম সেট করে দিই ঠিক অবচেতনভাবেই (সাব কনসিয়াসলি) সেটি সেভাবেই কাজ করে। মস্তিস্ক ও স্পাইনাল কর্ড মিলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (সিএনএস) গঠিত যা মূলত আমাদের দেহ ও মনের ভারকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। স্নায়ুতন্ত্রের লক্ষ কোটি নিউরণ কোষের এক্্রন ও ডেনড্্রাইডের সংযোগে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে সারাদেহে। একে প্রান্তিক য়ুকোষ (পিএনএস) বলে। দেহের যেকোন প্রান্তে কিছু ঘটলেই পিএনএস এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক অনুরূপ সিগনেল চলে যায় কেন্দ্রে আর সে অনুযায়ী মস্তিস্ক থেকে যথাস্থানে পৌছে যায় মটর রেসপন্স।

ফরাসী বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন ‘শতকরা পচাত্তর শতাংশ বিজ্ঞানীর মহা আবিস্কার হয়েছে যখন তারা নিজেরা সচেতন ছিলেন না। আমরা যখন খুব সচেতন ও সচেষ্ট থাকার চেষ্টা করি তখন আমাদের মস্তিস্ক অবচেতন অবস্থার চেয়ে অর্ধেক কাজ করতে পারে’। যেমনটি সকালে ট্রেন ধরার তাড়া থাকলে আমরা ঠিকই সময়মত জেগে উঠে পড়ি! অন্যসময় হয়তো এ্যালার্ম দিয়েও কাজ হয়না। আবার ক্রিকেট মাঠে অনেক সময় ফিল্ডাররা হাতের নাগালের বাইরের বলও ধরে ফেলে! ভেবেচিন্তে সা¦ভাবিকভাবে এ ধরণের ‘দুর্দান্ত ক্যাচ’ ধরার কথা না। কারণ হল আমাদের অবচেতন মনের অপরিমেয় ক্ষমতা।

এভাবে আমাদের ভাল কোন অভ্যাস গড়ে ওঠা, বড় কোন কাজের সক্ষমতা তৈরি বা অন্যের প্রতি প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে মন-মস্তিস্কের মিথঃস্ক্রিয়ার ওপর। বিজ্ঞানীরা বলেন একটানা একটি কাজ ২১ দিন করলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। নিজের ভিতরের বড় পরিবর্তনের জন্য এভাবে একটানা ২১ দিন অল্প অভ্যাস গড়ে ওঠে। দেহমনের উপর পূর্ন নিয়ন্ত্রন রেখে মস্তিস্কের অনুশীলনের মাধ্যমে ভাল অভ্যাস গঠন হয়। একটা বাজে অভ্যাস গঠন যতোটা সহজ ভাল অভ্যাস গড়ে তোলা যেন ততটাই কঠিন। সেটা সকালে ঘুম থেকে ওঠা হোক বা মিথ্যা বলা ত্যাগ করা, সময়ের কাজ সময়ে করা হোক কিংবা ধূমপান ছেড়ে দেয়া- সমস্ত ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতেই যেন আমাদের রাজ্যের আলসেমি।
মস্তিস্কের দুটি গোলার্ধ থাকে সেরিবেলাম ও সেরিব্রাম। মূলত সেরিব্রাম অনুভূতি নিয়ন্্রণ, স্মৃুতি সংরক্ষণ, ও শিক্ষনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। আরেকটি অংশ সেরিবেলাম মূলত ভারসাম্য নিয়ত্রণ করে ক্যাটেল হর্ন ক্যারল(সিএইচসি) থিওরির মতে, আমাদের মস্তিষ্ক দশটি মূল সক্ষমতায় পরিপূর্ণ যা কী না সত্তরটি বিস্তৃত সক্ষমতায় বিভক্ত থাকে। সফলতা অর্জন করার জন্যে সত্তরটি গুণেরই চর্চা করা করার কোন প্রয়োজন নেই। নিজের মধ্যে যে গুন রয়েছে তা খুজে বের করে কাজে লাগানোর উপর নির্ভর করে সফলতা।তারপরও সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। চাইলেও অনেক অভ্যাস সহজে পরিবর্তন হয়না; সবকিছু সবাই পারেনা। এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই শৈশবে। আমাদের বেড়ে ওঠা ধরণ, চারপাশের পরিবেশ, পরিচিত মানুষজনের আচরণ বিশ্লেষণ করলেই খুলে যাবে জট। একে বলা ট্রান্সসেকশনাল এ্যানালাইসিস (টিএ) ঞৎধহংধপঃরড়হধষ অহধষুংরং। কানাডিয়ান মনোবিজ্ঞানী এরিক বার্ন (ঊৎরপ ইবৎহব) এই ধারণার প্রবক্তা। পরবর্তীতে থমাস হেরিস (ঞযড়সধং অ. ঐধৎৎরং) আরো ট্রান্সসেকশনাল এ্যানালাইসিস (টিএ) আধুনিকায়ন করেন। বর্তমানে সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আচরণগত নানা দিক নিয়ে আলোচনায় ঞৎধহংধপঃরড়হধষ অহধষুংরং পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে মানুষের আচরণগত তিনটি পর্যায় বা বমড় ংঃধঃব এর কথা বলা হয়। এগুলো হল চধৎরবহঃ, অফঁষঃ ধহফ ঈযরষফ (চঅঈ) বমড় ংঃধঃব. এই তিনটি মিলেই মূলত মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আবচলনগত অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়।

চধৎরবহঃ বমড় ংঃধঃব এ অবস্থানকারী মানুষেরা সাধারণত তাদের পিতামাতা, শিক্ষক বা কতৃত্বশীল কোন ব্যক্তির মত আচরণ করে। এমনকি ধর্মীয় প্রভাব বা সামাজিক প্রথা তাদের আচরণগত বৈশিষ্ট্যে ফুটে ওঠে। তাদের মনে It’s wrong, Its right, itÕs ok. Bad. You should. Shouln’t.জাতীয় পুরণো রের্কড বাজতে থাকে।
চধৎরবহঃ বমড় ংঃধঃব দুধরণের হতে পারে

Narturaing Parent (NP)
 Critical Parent (CP).
সহানুভূতিশীল, মিশুক, পরোপকারী ব্যক্তিরা ঘধৎঃঁৎধরহম চধৎবহঃ (ঘচ) ও হয়ে থাকে অপরদিকে দোষারোপকারী, সমালোচনাকারী এবং নিয়ন্ত্রনমূলক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা ঈৎরঃরপধষ চধৎবহঃ (ঈচ) বমড় ংঃধঃব.
অফঁষঃ বমড় ংঃধঃব এর ব্যক্তিরা বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন থাকে। ফলে তারা যেকোন পরিস্থিতিতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, দ্রুত সমস্যা সমাধান করে। এ পর্যায়ের ব্যক্তিদের কাজ অনেকটা কম্পিউটারের মত। তারা তথ্য সংগ্রহ করে, যাচাই বাছাই ও মূল্যায়ন করে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তারা সবসময় বাস্তবতা অনুধাবন করে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতের হিসেব কষে সিদ্ধান্ত নেন।

ঈযরষফ বমড় ংধঃব এর ব্যক্তিদের আবেগি আচরণ ও শিশু সুলভ মনোভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। আনন্দ, রাগ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া এ ধরণের ব্যক্তিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে বড়কালেও ছোটবেলার ব্যাপারগুলো সক্রিয় থাকে। তবে এর মানে এই নয় যে তারা পুরোপুরি অপরিপক্ক। ঈযরষফ বমড় ংধঃব কয়েক ধরণের হতে পারে। যেমন Natural Child (NC) পর্যায়ের মানুষেরা খুবই উৎসুক ও উৎফুল্ল হতে পারে । অফধঢ়ঃবফ Adapted Child (AC) পর্যায়ের ব্যক্তিরা নিজেদের বেশি ভীত, বিনীত, দোষী বা লজ্জিত মনে করে। জবনবষষড়ঁং ঈযরষফ(জঈ)। এর আক্রমনাত্বক, প্রতিবাদী ও অবাধ্য আচরণ লক্ষ্য করা যায় যাদেরকে অনেক সময় অনেকের মাঝে সৃজনশীল উদ্ভানীমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায় যাদেরকে বলা হয় Little Professor (LP).

অনেকসময়  Adult ego state এর সাথে ঈযরষফ বা চধৎবহঃ এর মিশ্রনে নতুন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যাকে কন্টামিনেশন বলে। যখন এই মিশ্রনটি চধৎবহঃ থেকে আসে তখন অনেকটা কুসংস্কারমনা আচরণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন ছোটবেলায় বাবা মা অভিভাবকের প্রভাব ধারণ করে। যেমন-শনিবার যাত্রা করা অশুভ।
এ মিশ্র আচরণে অনেকসময় ঈযরষফ বমড় ংঃধঃব এর প্রভাব স্পষ্ট হতে পারে এটাকে ডিলিউশন (Delusion) বলে। এ ধরনের ব্যক্তিরা সবসময় এক ধরণের শঙ্কায় ভুগতে থাকে। তাদের ধারণ অন্যরা তাকে নিয়ে সমালোচনা করছে; ষড়যন্ত্র করছে। এভাবে ছোটবেলা থেকে আমাদের বেড়ে ওঠার মাধ্যমে নিজের এবং অন্যের সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া তৈরী হয় তাকে লাইফ পজিশনিং বলে। প্রত্যেক ব্যক্তির লাইফ পজিশনিং অনুসারে নিজের চাহিদামত পাওয়া না পাওয়ার প্রক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াকে বলে ঙকধুহবংং. নিজের ego state বোঝার পরই নিজেকে বলা যাবে I am OK.

-নাজমুল হুদা
উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
অনুপ্রেরণামূলক বক্তা, লেখক ও সংগঠক