
করোনাতঙ্কে ভুগছেন?
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এখন করোনাভাইরাসে নয়, বরং করোনাতঙ্কে ভুগছেন!
বিশ্বের জনসংখ্যা এখন ৭৫৩ কোটি আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ৩২ হাজার ২৫৭। [www.worldometers.info] তার মানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.০০৩৩% মানুষ এ রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ১,২৪,৩৩২ জন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। ৩,৬৪,২০৬ জন সামান্য অসুস্থতা নিয়ে ভুগলেও আশা করা যায় এঁরা সবাই অচিরেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। কেননা পরিসংখ্যান বলছে- এ রোগে আক্রান্তের ৯৫ ভাগই ‘মৃদু’ আক্রমণের কবলে পড়েন। লক্ষণ প্রকাশের দু’-তিন সপ্তাহের মধ্যেই তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন। লক্ষণ বলতে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা আর সামান্য দুর্বলতাবোধ (সাইকোলজি টুডে, ২৮ ফেব্রুয়ারি)। মাত্র ৫% মানুষ (এ মুহূর্তে ১৯৬৩৫ জন) সংকটাবস্থায় আছেন, যারা সুস্থ হতে পারেন, আবার ভিন্ন কিছু হতে পারে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তুলনায় হারটা মাত্র ০.০০০০২৫%!
প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনা, হৃদরোগ বা আত্মহত্যার কারণে ঢের বেশি লোক মারা যায়। পৃথিবীতে প্রতিবছর সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায় ১২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ। হৃদরোগে শুধু আমেরিকায় প্রতিবছর মারা যায় আট লক্ষ মানুষ (আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন) আর প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে (ডব্লিউএইচও)! করোনাভাইরাস নিয়ে যে আতঙ্ক ইতোমধ্যে আমাদেরকে গ্রাস করছে, তার ভগ্নাংশও যদি মৃত্যুর অন্যান্য কারণগুলোর ব্যাপারে থাকত, তাহলে বহু মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হতো!
ইনফ্লুয়েঞ্জাতে কত লোক আক্রান্ত হয়?
বলবেন- এসব রোগ আর করোনা এক হলো? 'প্যানডেমিক' বা বৈশ্বিক মহামারী (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছে) বলে কথা। ‘কোভিড-১৯’ বা ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ’টি আসলে ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার এক নতুন ধরন, যা অতীতে দেখা যায়নি। আপনি কি জানেন- শীতের শুরুতে এবং শেষে যে সিজনাল ফ্লু হয়, এতে আক্রান্ত হয় ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ মানুষ (সাইকোলজি টুডে, ২৮ ফেব্রুয়ারি) এবং এ সংখ্যাটা জানা যাচ্ছে, কারণ এই সংখ্যক মানুষেরা চিকিৎসক বা হাসপাতালের শরণাপন্ন হন। সাধারণ মাত্রায় ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে যারা ডাক্তারের কাছে যানই না (এবং বেশিরভাগ মানুষই তা করেন), তাদের হিসাব ধরলে সংখ্যাটা অনেক বড়!
ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যু বনাম করোনায় মৃত্যু
সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জাতে মৃত্যুর সংখ্যা ২,৯০,০০০ থেকে ৬,৫০,০০০ মানুষ (সাইকোলজি টুডে, ২৮ ফেব্রুয়ারি) এবং এ মৃত্যু শুধু গরিব দেশগুলোতে নয়, ধনী দেশগুলোতেও হয়। ২০১৪-১৫ সালে ব্রিটেনে সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যায় ২৮ হাজার মানুষ (পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড; আইটিভি, ৬ ফেব্রু, ২০২০), ২০১৬-১৭-তে ফ্রান্সে ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যায় ১৪ হাজার মানুষ (দ্য কানেক্সিয়ান, ২১ মার্চ, ২০২০), ২০১৭-১৮তে আমেরিকায় ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যায় ৬১ হাজার মানুষ (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন), অথচ এই তিনটি দেশে গত তিনমাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা : বৃটেন- ৫৭৮, ফ্রান্স-১৬৯৬ এবং আমেরিকা-১৩০০ (২৭ মার্চ, দুপুর ১২:০৪মি) আর সমগ্র পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২৪,০৯৫ জন (২৭ মার্চ, দুপুর ১২:৪০মি, www.worldometers.info)। এদের একটা বড় অংশই আগে থেকে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন এমন বৃদ্ধ মানুষ। তার মানে রোগটি মারাত্মক প্রাণঘাতী নয়, তবে খুবই সংক্রামক। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে খুব সহজেই এটি অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা।
করোনা-ভয়কে করুন জয়!
-সঙ্গে সবসময় এক বা একাধিক রুমাল রাখবেন যেন হাঁচি-কাশিতে ব্যবহার করতে পারেন
-নিয়মিত ঘনঘন ভালোভাবে হাত ধুলে এই জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। হ্যান্ডওয়াশ বা স্যানিটাইজার না হলেও চলবে। বেশি ক্ষারযুক্ত সাবান (‘বাংলা সাবান’) বরং বেশি ভালো
-কাউকে হাঁচি-কাশি দিতে দেখলে তার থেকে দু-তিন ফুট দূরত্বে চলে যান
-আপনি অসুস্থ না হলে মাস্ক ব্যবহার না করলেও চলে, কিন্তু যদি করেন তবে সেটা যথাযথ নিয়ম মেনেই করতে হবে
-জ্বর বা এজাতীয় লক্ষণ দেখা দিলে কোয়ারেন্টিনে থাকুন
-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ইতিবাচকতার শক্তি বাড়ানোর জন্য নিয়মিতভাবে মেডিটেশন করুন। নামাজ/উপাসনায় করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি ও সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করুন। শুধু নিজের জন্যে নয়, সারা দেশ ও বিশ্বের জন্য দোয়া করুন।
সামষ্টিকভাবে বাসায় থাকার সময়টাকে কাজে লাগান!
-ভোরে ঘুম ভাঙলেই বলুন শোকর আলহামদুলিল্লাহ, তোমাকে ধন্যবাদ। নামাজ আদায়ের পর ৪০ বার দোয়া ইউনুস ও বেশ কয়েকবার দরুদ পড়ুন। সনাতনধর্মীরা ৪০ বার গায়ত্রী মন্ত্র, বৌদ্ধরা বুদ্ধমন্ত্র ও খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মানুসারে প্রার্থনা করতে পারেন।
-হালকা কিছু খেয়ে (কাঁচা ছোলা অথবা দুই/তিনটা খেজুর) দমর্চচা ও ইয়োগা করুন। অন্যদের অসুবিধা সৃষ্টি না করে ঘরের মধ্যেই হাঁটুন বা দৌড়ান।
-পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে নাস্তা করুন। নাস্তায় এক কোষ কাঁচা রসুন ও ২৫/৩০টি কালোজিরার দানা খান। একগ্লাস লেবুপানিতে এক চামচ মধু মিশিয়ে খেতে পারেন।
-পরিবারের সাথে একাত্ম হওয়ার এ এক চমৎকার সুযোগ! পরিবারের সদস্যদের কোয়ালিটি টাইম দিন। শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গঠনমূলক আলোচনা, শিক্ষামূলক গল্প কবিতা গান ইত্যাদির ভেতর দিয়ে একাত্ম হোন। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা করুন।
-স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে মনোযোগী সময় দিন। অতীতের নেতিবাচক বিষয় নিয়ে আলোচনা বর্জন করে পরিবারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করুন।
-বাবা-মাসহ বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের সুখ-দুঃখের কথা শুনুন।
-নিজের পরিবারের বাইরে আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর রাখুন নিয়মিত।
-পরিবারে বই পড়া ও বই নিয়ে পর্যালোচনা করার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারেন।
-কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী যারা হোম-অফিস করছেন তারা আন্তরিকতার সঙ্গে অফিসের কাজটুকু করুন। সুযোগ থাকলে পারিবারিক কাজ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশ নিন। আপনার এই ছোট্ট সহযোগিতা পারিবারিক একাত্মতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
-শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়ালেখা অব্যাহত রাখুন।
-খাবারের ক্ষেত্রে আদর্শ খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন। প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে ফলমূল, শাকসবজি বেশি খান। পানি বেশি করে পান করুন। চর্বিদার ও গুরুপাক খাবার যত কম খাবেন, তত ভালো। প্রতিবেলায় খাবার পরিবারের সবাই একসঙ্গে খাবেন।
যা করা উচিত নয়
-দিনভর টিভি/ইন্টারনেট/সামজিক মাধ্যমের সংস্পর্শে থাকা এড়িয়ে চলুন। কিছুক্ষণ পরপর সংবাদ দেখা ও শোনা থেকে বিরত থাকুন।
-গুজবে কান দেয়া ও গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন। আতঙ্কিত না হয়ে বরং অন্যদের মাঝে সাহস সঞ্চার করুন।
-বালা মুসিবত থেকে বেঁচে থাকার জন্য গীবত, পরচর্চা, দুর্ব্যবহার, নেতিবাচক আলোচনা, নেতিবাচক ছবি, সংবাদ বা ভিডিও দেখা ও শেয়ার করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।
অধীনস্থকে ছুটি দিলে অগ্রিম বেতন দিয়ে দিন। আপনার সঙ্গে সম্পর্কিত অধীনস্থদের (গৃহকর্মী, ড্রাইভার, মালী প্রমুখ) প্রতি মানবিক আচরণ বজায় রাখুন। তাদের দুঃসময়ে যথাসম্ভব সহযোগিতা করুন। ছুটি দিলে অন্তত এক মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দিন।
সবশেষে বিশ্বব্যাপী করোনা-ভাইরাস নিয়ে কিছু ভালো খবর-
-চীন তার শেষ করোনা-হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ আলাদা হাসপাতাল চালানোর মতো পর্যাপ্ত রোগী আর সেখানে নেই
-এক সপ্তাহে উহান (চীনের যে শহর থেকে প্রথম এ রোগের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল) আর কোনো নতুন রোগী পাওয়া যায়নি বিধায় ৮ এপ্রিল থেকে উহানের লক ডাউন তুলে নেওয়া হচ্ছে
-বলা হয়, করোনাভাইরাসের ঘাতক প্রভাব বয়স্কদের ওপর নাকি বেশি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বয়স্ক অনেকেরই খবর পাওয়া যাচ্ছে, যারা করোনাক্রান্ত হওয়ার পরও সেরে উঠেছেন। তাদেরই একজন চীনের সবচেয়ে বর্ষীয়ান করোনারোগী উহানের ৯৮ বছর বয়সী এক নারী। জ্বর এবং হার্টের সমস্যা নিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে লিশানশান হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি সুস্থ হয়ে ১ মার্চ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
-করোনাভাইরাস পরীক্ষার কীট উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত আক্রান্ত ৪৪ জন। এদের মধ্যে ১১ জনই ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন। কাজেই আসুন আতঙ্কিত নয়, সচেতন হই-সতর্ক হই।
তথ্যসুত্র : কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন