
সফল মানুষদের সকালের ৬টি অভ্যাস
সকাল আটটার আগের ছয়টি অভ্যাস যা আপনার জীবনকে পরিবর্তন করবে
হাল এলরড, ১৯৯৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর একটি গাড়ী তার গাড়ীকে ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনাটিতে তার শরীরের এগারোটি হাড় ভেঙ্গে যায় এবং তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। ছয় মিনিট পর পুনরায় তার হার্টবিট শুরু হয়। ছয়দিন পর্যন্ত তিনি কোমায় ছিলেন। সপ্তম দিন তার জ্ঞান ফিরে এবং তার এই অবস্থা দেখে ডাক্তার জানায় সে কখনো চলাফেরা করতে পারবে না। কিন্তু হাল এলরড জীবনের কাছে হার মানেনি এই ঘটনার কয়েক বছর পর হাল একজন পেশাদার বক্তা, জনপ্রিয় লেখক এবং আলাট্রা মেরাথন দৌড়বিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অনেকটা মৃত্যুর পর তিনি আবার বেচে উঠেন এবং বেচে উঠার পর ডাক্তারের সকল অনুমানকে মিথ্যে প্রমানিত করে আজ তিনি এই অবস্থানে পৌছান। হাল বলেন এর জন্যে সবচাইতে প্রথমে আপনাকে ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে।
কোমা থেকে উঠার পর তিনি ছয়টি প্রাত্যহিক অভ্যাস করেছিলেন যা তার জীবনকে বদলে দিয়েছিলো। যেগুলো তিনি প্রতিদিন অনুশীলন করতেন। এই সব তিনি শিখেছিলেন বিভিন্ন বই পড়ে এবং অন্যসব সফল মানুষদের কাছ থেকে। হাল এলরড তার সর্বাধিক বিক্রিত বই ‘দ্য মিরাকল মর্নিং’ এ তার এই সব অভ্যাসের কথা বর্ণনা করেন। আজ আমি আপনাদের সেই বই থেকে ভোরের ছয়টি অভ্যাসের কথা বলবো যা হাল প্রতিদিন অনুশীলন করতেন। এই অভ্যাসগুলো অনুসরণ করে আপনিও একজন সফল মানুষে পরিনত হতে পারেন।
এই ছয়টি অভ্যাস খুবই কার্যকরী ছিলো তাই লেখক এই অভ্যাসগুলো প্রতিদিন অনুশীলন করতেন। যখন তিনি এগুলো শুরু করেছিলেন তখন তার পনরো হাজার ডলার ধার ছিলো, নিজের বাড়িটিও বিক্রি হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। তিনি একদম স্বাস্থ্যহীন এবং বিষন্ন ছিলেন। এই ছয়টি সকালের অভ্যাস নিয়মিত শুরু করার পর দুমাসের মধ্যে তার উপার্জন দ্বিগুন হয়ে যায়। নিজের বাড়িটি বিক্রির হাত থেকে বাচান। কিছুদিন পরে সুস্থ্য হয়ে আলট্রা মেরাথন দৌড়বিদ হন এবং একজন সুখী মানুষও হন। সেই ব্যাক্তিটি যাকে ডাক্তার বলেছিলো কখনো চলতে পারবেনা। এসব এতো তাড়াতাড়ি হয়েছিলো যে হাল নিজেই অবাক হয়ে যান। তাই তিনি বইটির নাম রাখলেন ‘মিরাকল মর্নিং’ যার অর্থ দাড়ায় ‘অলৌকিক সকাল’। কারণ তার কাছে এগুলো অলৌকিকই মনে হচ্ছিলো। এবার আপনাদের সেই সকল অভ্যাসগুলোর কথা বলবো যা আপনি অনুসরন করবেন একদম রুটিন মাফিক।
প্রথম অভ্যাসটি হলো "নিরবতা"ঃ লেখকের কাছে নিরবতা মানে ধ্যান অথবা প্রার্থনা। বেশিরভাগ মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাজ্যের চিন্তায় মশগুল হয়ে যান। কেউ খবরের কাগজ পড়েন আবার কেউ ফেসবুকিংয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। কিন্তু সফল মানুষেরা এগুলো করেন না। তারা সাধারনত সকালে ঘুম থেকে উঠে নিরব থাকেন। মানে ধ্যান, ইয়োগা অথবা প্রার্থনা করেন যা তাদের মস্তিককে শিথিল করে দিনের ভালো একটা শুরু দেয় এবং মস্তিককে সর্বোচ্চ কর্মক্ষম করে দেয়। প্রথমে লেখকের মনে হতো মেডিটেশন বা প্রার্থনা একটি ধর্মীয় ব্যাপার মাত্র যার সাথে সফলতার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি গরেষনা করে এবং সফল মানুষদের জীবনী পড়ে জানতে পারেন মেডিটেশন এমন একটি হাতিয়ার যা সফল মানুষদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। বিলিওনিয়ার হ্যাচ ফান্ড ম্যানেজার রে ডালিও বলেন মেডিটেশন তার সফলতার এক নম্বর চাবিকাঠি। শুধুমাত্র তিনিই নন পৃথিবীর অনেক বড় বড় প্রধান নির্বাহী নিজেদের মস্তিস্কককে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মক্ষম এবং নিয়মানুবর্তিত রাখার জন্য মেডিটেশনকেই কৃতিত্ব দেন। এর জন্য সর্বপ্রথম যা করতে হয় তা হচ্ছে নিরবতার অনুশীলন।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে নিজের সাথে কথোপকথনঃনিজের সাথে সুনিশ্চিতভাবে কথা বলা সফলতার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি পেশাদার দৌড়বিদ, অভিনেতা এবং সফল উদ্যোক্তারা করে থাকেন। এই কাজটি আপনি আপনার জীবনের লক্ষ্য লিখেও করতে পারেন। তিনটি কথা আপনি লিখতে পারেন;
১. আপনি আপনাকে কেমন দেখতে চান?
২. আপনি এই পরিবর্তনগুলো কেনো চান?
৩. এই কাজগুলো করার জন্য আপনি কি কি অঙ্গীকার করছেন?
এই কথাগুলো একটি ডায়েরিতে লিখুন এবং প্রতিদিন সকালে পড়ুন।
তৃতীয়টি হচ্ছে নিজের কল্পনা শক্তির ব্যবহারঃ নিজের সাথে কথোপকথোন এবং কল্পনা শক্তির ব্যবহার দুটো যেনো জময ভাইবোনের মতো। আপনার মনে হতে পারে এই দুটি একই বিষয়। কিন্তু আসলে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয়। কথোপকথোন আপনাকে সাহায্য করে আপনার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগুলোকে মনে রাখতে এবং আপনার শেষ ইচ্ছেগুলো কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা দেয় । ধরুণ কল্পনা হচ্ছে একটি দৃশ্য এবং কথোপকথোন হচ্ছে তার ধ্বনি বা আওয়াজ।
আপনি যে কথোপকথোনগুলো করছেন বা লিখছেন তা অর্জন করার জন্য আপনাকে সেগুলো কল্পনা করতে হবে। উদাহরণসরূপ ধরুন আপনি একটি পরীক্ষা দিবেন। কল্পনা করুন আপনি কেমনভাবে প্রস্তুতি নিবেন। কল্পনা করুন আপনি অনেক রাত পর্যন্ত পড়ার টেবিলে বসে বই পড়ছেন, বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন, নোট তৈরি করছেন। অথবা মনে করেন আপনি পিয়ানো বাজানো শিখবেন। আপনি কল্পনা করুন আপনি পিয়ানোর কীবোর্ডে হাত রাখছেন। আপনার প্রিয় গানটি বাজাচ্ছেন। কল্পনা হচ্ছে ছোট ছোট সিঁড়ির মতো এটি আপনাকে সাহায্য করবে সকালের অনুশীলন শেষ হবার পর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সবার প্রথমে করতে। কথপোকথোন এবং কল্পনা শক্তির ব্যবহার আপনার প্রাত্যহিক কাজ সম্পর্কে আপনার ভাবনা বদলে দেবে।
চতুর্থ অভ্যাস হচ্ছে শরীরচর্চা বা ব্যায়ামঃ আমরা সবাই জানি শরীরচর্চা আমাদের শরীরের জন্য খুবই জরুরী। কিন্তু আমরা বেশীরভাগ মানুষই এটিকে এড়িয়ে চলি। ব্যায়াম না করার জন্য আমাদের অনেক বাহানা থাকে তার মধ্যে সবথেকে প্রচলিত বাহানাগুলো হচ্ছে আজও অনেক দেরি হয়ে গেছে, আটটা বেজে গেলো এখন ব্যায়াম করে কি হবে, কাল থেকে শুরু করবো। এই বাহানা থেকে আপনাকে বের হতে হবে। আপনাকে সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। বিশ থেকে একুশদিন একটু কষ্ট করে সকাল সকাল উঠলেই এটি অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাবে। সকালে ব্যায়াম করার অনেক বৈজ্ঞানিক উপকারিতা রয়েছে। ব্যায়াম করার ফলে আপনার মস্তিস্কে বেশী পরিমান অক্সিজেন যায় এবং এটি আপনার মস্তিস্কে এন্ডোরফিন রস নিঃস্বরণ করে। এতে আপনার চিন্তা অনেক স্বচ্ছ বা পরিস্কার হয়, আপনি ভালো বোধ করবেন, সারাদিনের জন্য আপনার কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে। ব্যায়াম করার জন্য লেখক ব্যায়ামাগারে যেতে বলেননি। আপনি পার্কে যেতে পারেন, বাসার আশেপাশে কোনো মাঠে অথবা বাসায়ই ব্যায়াম করতে পারেন। কোনো যন্ত্রের দরকার নেই খালিহাতে ব্যায়াম যেমন: দৌড়, বুকডন এবং খালিহাতের অন্যান্য ব্যায়ামগুলো করতে পারেন।
পঞ্চম অভ্যাসটি হচ্ছে পড়াশুনা করাঃ পড়াশুনা ব্যাক্তিগত উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে ভালো একটি উপায়। প্রতিদিন সকালে অন্তত দশপৃষ্ঠা বই পড়ার চেষ্টা করুন, এই হিসাবে আপনি বছর শেষে তিন হাজার ছয়শত পঞ্চাশ পৃষ্ঠা পড়ে ফেলবেন যেটি প্রায় সতরো আঠারোটি বইয়ের সমান। সত্যিই দেখুন একটি ছোটো প্রতিজ্ঞা আপনার জীবনে কতো বড়ো পরিবর্তন আনতে পারে।
ষষ্ঠ এবং শেষ অভ্যাসটি হলো লেখাঃ প্রতিদিন সকালে কয়েক মিনিট ব্যয় করুন আপনার চিন্তা এবং আবেগগুলো লিখতে। এটি থেকে আপনি প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখবেন। এটিকে ইংরেজীতে ‘মর্নিং পেইজ’ বলে বাংলায় আমরা ‘ভোরের পত্র’ বলতে পারি। হাল এই পত্রটিকে দুই ভাগে লিখতেন প্রথম ভাগে লিখতেন ‘আজকের শিক্ষা’ অর্থাৎ এখন পর্যন্ত আমি কি কি শিখেছি আর কি কি পেয়েছি এবং দ্বিতীয় ভাগে লিখতেন নতুন পরিকল্পনা অর্থাৎ আরোও নতুন কি শিখতে হবে বা আরো কি করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি হালকে সাহায্য করেছিলো লক্ষ্যে অটুট থাকতে।
এই প্রাত্যহিক কার্যকলাপ অনুসরন করার জন্য আপনাকে যে কাজটি সর্বপ্রথম করতে হবে তা হচ্ছে ভোরে ঘুম থেকে উঠা। এই সব নিত্যকর্ম সকাল আটটার মধ্যে শেষ করতে হবে। যেমন এই বইটির বিকল্প শিরোনাম হলো ‘সকাল আটটার আগের ছয়টি অভ্যাস যা আপনার জীবনকে পরিবর্তন করবে’। যদি আপনি আপনার দিনের শুরুটি ঘড়ির অ্যলার্মের বিরতি দিতে দিতে ঝিমুনি দিয়ে শুরু করেন তাহলে এই রুটিন কাজ করবেনা। এমন করলে আপনি আরো বেশী ক্লান্ত বোধ করবেন। এটি করলে আপনি গভীরভাবে ঘুমাতেও পারবেননা। বরং আপনি নিজের অজান্তেই আপনার অবচেতন মনকে তথ্য দিতে থাকবেন যে আপনি দিনটি শুরুই করতে চান না। যদি আপনি আপনার জীবনকে হ্যা বলতে চান তাহলে অ্যলার্মের বিরতি বাটনকে না বলুন।