
উন্নয়নের নায়ক – ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা “ফজলে হাসান আবেদ”
‘দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন’ এই দুই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ব্র্যাক তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রঋণ তথা উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্র্যাক যে বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তা এদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সংগ্রামে উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে থাকবে। ব্র্যাকের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে ফজলে হাসান আবেদের কঠিন পরিশ্রম, নিরন্তর উদ্ভাবনা এবং আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত বারবার উন্মোচিত হয়।চেষ্টা করেছি। এমন কোনো কাজ আমি করতে চাইনি, যে কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারব না। যে কাজই করিনা কেন, ভালভাবে করব, এটাই আমার নীতি। ব্র্যাক শুরু করার সময়ও কথাটা আমার মাথায় ছিল। নিজেদের অর্থ দিয়ে ব্র্যাকের কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়, কিন্তু তা দিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। সেজন্যই আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। পরবর্তী সময়ে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো আমাদের কার্যক্রমে তহবিল জোগান দিয়েছে। ফলে কাজ করা সহজ হয়েছে। প্রথম যে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে অর্থ প্রদান করেছিল, সেটি হল, অক্সফাম-জিবি। অক্সফাম প্রায় দুই লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিল। এই অর্থ দিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছিলাম। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে আমি লন্ডন গেলাম। অক্সফামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। লক্ষ্য করলাম তাঁরা আমাদের কাজে খুবই খুশি। তাঁরা বললেন, ‘সারা পৃথিবীতে আমাদের প্রায় সাতশ প্রোজেক্ট আছে। এর মধ্যে যে প্রোজেক্টগুলো সবচাইতে ভাল চলছে, ব্র্যাক তার অন্যতম। অল্প সময়ের মধ্যে ব্র্যাক অনেক কাজ করেছে, যে কাজগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ছিল খুবই জরুরি।’ অক্সফামের কর্তাব্যক্তিদের এই সন্তুষ্টির যথাযথ কারণ ছিল।”
ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্নের ব্র্যাক আজ বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে। এদেশের সব কয়টি জেলায় ব্র্যাক সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। দেশের ৭৮ শতাংশ গ্রামে এর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। এ ছাড়া স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে ব্র্যাককে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তানেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আফগানিস্তানে ব্র্যাক সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।হেলপ নামক সংগঠনের জন্ম :
মূলত ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় অঙ্কুর আকারে ব্র্যাকের সূচনা হয়েছিল। সে বছর ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকা এবং সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা এই তিনটি স্থানে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়। দ্বীপগুলো পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মনপুরা দ্বীপে বেঁচে যাওয়া তের হাজার মানুষের কোন সহায়-সম্বল ছিল না।
ঘূর্ণিউপদ্রুতদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন। এ সময় ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, শেলে তাঁর সহকর্মী কায়সার জামানসহ আরও কয়েকজন। ‘হেলপ’-এর মাধ্যমে তাঁরা মনপুরাতে কাজ করতে থাকেন। এসময় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনদের রিলিফ দেওয়া, তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করা প্রভৃতি কাজ করেছেন। শুরুতে নিজেরা টাকা তুলে সেই টাকা দিয়ে কাজ করেছেন। পরে জার্মানির একটি সংস্থা ত্রাণ কাজ চালানোর জন্য তাঁদেরকে ৩ মিলিয়ন ডয়েচ মার্ক অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা আকবর কবীর (পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং অ্যাকশন বাংলাদেশ এর জন্মঃ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফজলে হাসান আবেদ চলে যান লন্ডনে। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটা সংগঠন তৈরি করা। এ সময় তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে চাকরি করছিলেন। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানীরা সর্বাত্মক সামরিক হামলা চালায়। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একসময় চট্টগ্রাম শহর হানাদারদের দখলে চলে যায়। ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ পুনঃস্থাপিত হলে ফজলে হাসান আবেদ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে ফজলে হাসান আবেদের জন্ম। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের অনেক বড় জমিদার। তাঁরা ছিলেন দুই পরগনার মালিক। ফজলে হাসান আবেদের পরিবারের সবাই ছিলেন শিক্ষিত। দাদারা ছিলেন চার ভাই। তাঁরা সকলেই কলকাতা গিয়ে পড়াশুনা করেছেন। এফএ পাশ করে সরকারী চাকরি করেছেন। ফজলে হাসান আবেদের দাদা খানবাহাদুর রফিকুল হাসানের চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে তাঁর বাবা সিদ্দিক হাসান ছিলেন সবার বড়। তাঁর মেজ চাচা রাশিদুল হাসান ছিলেন জেলা জজ। আরেক চাচা ওবায়দুল হাসান ছিলেন নামকরা ডেন্টিস্ট। দেশভাগের আগে তিনি আসামের শিলচরে প্র্যাকটিস করতেন, পরে ঢাকায় চলে আসেন। ছোট চাচা একাত্তরের শহিদ সায়ীদুল হাসান। ফজলে হাসান আবেদের মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন খাতুন। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল অনেকটা ফরমাল, তবে বাবার চাইতে মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। মায়ের প্রতি আমার দুর্বলতাও ছিল বেশি। আমার মায়ের কিছু বিশেষ গুণ ছিল। আর এই গুণগুলোই তাঁকে অন্য অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট করে রাখত। তাঁর মনটা ছিল খুব দয়ালু। মানুষের জন্য গভীর মমতা ছিল তাঁর। তিনি সর্বদাই দুঃস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কারও ঘরে খাবার নেই এ খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য চাল পাঠিয়ে দিতেন। কারও অসুখ হলে চিকিত্সার ব্যবস্থা করতেন। রাতের বেলা কারও ঘরে হয়ত আলো জ্বালার কেরোসিন নেই। খবর পেয়ে ঐ বাড়িতে কেরোসিন পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে নানা উপায়ে তিনি অসহায় দরিদ্র লোকদের সাহায্য করতেন। এজন্য এলাকায় তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। মনে হয় মায়ের এই প্রবণতাগুলো কিছুটা হলেও আমি পেয়েছি।’
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ব্র্যাকের জন্ম। সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ–এই সাতজনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হল। বোর্ড ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল হলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সৈয়দ হুমায়ুন কবীর ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ড সম্পর্কে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘পরিচালনা বোর্ডে সদস্য নিযুক্তির ব্যাপারে আমি আগাগোড়া সতর্ক ছিলাম। সবসময় এমন কৃতী মানুষদের আনতে চেয়েছি যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে সংগঠনের জন্য কাজ করবেন। যাঁরা ব্র্যাকের কাছে কিছুই চাইবেন না। কিন্তু দেবেন অনেক কিছু। … ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যগণ কখনও কোনো চাহিদা নিয়ে ব্র্যাকের কাছে আসেননি। বোর্ডের কোনো সদস্য কোনোদিন বলেননি, আমার গাড়ি লাগবে বা আমার আত্মীয়কে চাকরি দিতে হবে। এখনও যাঁরা ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন, তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন। ব্র্যাক যে আজ এত বড় হয়েছে, তার অনেকটা কৃতিত্ব বোর্ডের সদস্যদের। যে কোনো অবস্থায় বোর্ড আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।’
যেভাবে ব্র্যাকের কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন ফজলে হাসান আবেদ :
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। কিন্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথায়? লন্ডনে ফজলে হাসান আবেদের একটি ছোট ফ্ল্যাট ছিল। একাত্তরে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করার সময় তিনি নিজের খরচ চালানোর জন্য ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দেন। বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৬৮০০ পাউন্ড। লন্ডনের একটি ব্যাংকে এই অর্থ তিনি রেখে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ঐ অর্থ দিয়ে তাঁর পরবর্তী তিন-চার বছরের খরচ চলে যাবে। এবার ব্র্যাকের কাজ শুরু করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ লন্ডনের ব্যাংক থেকে ঐ অর্থ তুলে দেশে নিয়ে এলেন। এ ছাড়া কলকাতার ব্যাংকে ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে ছিল ২৫ হাজার রুপি। এই ৬৮০০ পাউন্ড এবং ২৫ হাজার রুপি দিয়ে শুরু হল শাল্লার মানুষের জন্য ‘রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মসূচি। সুতরাং বলা চলে, ব্র্যাকের প্রথম ‘ডোনার’ হচ্ছেন ফজলে হাসান আবেদ। শাল্লায় কাজ শুরু করার প্রথম অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা শাল্লায় গিয়ে প্রথম দিনই দশ-বারজন তরুণকে খুঁজে বের করলাম, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বসে আছে। কোনো কাজ নেই। দিনপ্রতি ১০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাদেরকে জরিপের কাজে লাগিয়ে দিলাম। কিছু ছেলেকে কাজে লাগালাম যারা এস.এস.সি. পাশ। তাদের পারিশ্রমিক দিনে ৫ টাকা। সে সময় ১০ টাকা বা ৫ টাকা একেবারে কম নয়। তারা কাজ করতে থাকল। জরিপের মাধ্যমে কত বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আগে কী ধরনের কাজ করত, এখন কী কাজ করতে পারবে, তার সমস্ত তথ্য-উপাত্ত পেয়ে গেলাম। …জরিপের তথ্য-উপাত্ত হাতে পাওয়ার পর যোগাযোগ করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ও অর্থনীতি বিভাগের সঙ্গে। তাঁদের কয়েকজন শিক্ষক এবং পাশকরা ছাত্রছাত্রী জরিপের তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণের কাজে লেগে গেলেন।
সংগৃহীত
ইয়াদুল হক
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়